বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১৫ অপরাহ্ন

সর্বশেষ :
শাকিবকে জড়িয়ে ধরে ‘ইমোশনাল’ পরীমণি মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নপূরণে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধঃ ড. ইউনূস শেষ মুহূর্তে ভারতীয় দলে একাধিক পরিবর্তন ফের গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আটকে দিলো যুক্তরাষ্ট্র আগামী বছর জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন এক যুগ পর বিকেলে সেনাকুঞ্জে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া পলাশবাড়ীতে ওয়ালটন ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ ও পুরস্কার বিতরণী পলাশবাড়ীতে ২০ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রয় নিষিদ্ধ স্যাম্পল ওষুধ জব্দ ঢাকার সড়কে অটোরিকশা চালকরা, বন্ধ যান চলাচল সশস্ত্র বাহিনী দিবসঃ শিখা অনির্বাণে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা

বে-পরোয়া ভাবে দখল হচ্ছে শালবন নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য [কৌশলী ভূমিকায় দায়িত্বরত বন কর্মকর্তাগণ]

মোঃ বিপ্লব হোসেন (ফারুক), গাজীপুরঃ গাজীপুরে শালবন দখলদারদের দখলদারিত্ব কিছুতেই আর থামছে না চলছে আলো আঁধারের খেলা। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনের নীরবতায় জেলার বন সমৃদ্ধ প্রতিটি মৌজায় বন দখল ব্যাপকহারে শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন এলাকায় বনের গাছ কেটে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি, দোকান পাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। বনদস্যুদের হুমকি-ধমকিতে বন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বন রক্ষার চেয়ে আত্মরক্ষায় বেশি ব্যস্ত। বন দখলকারীদের হামলায় আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন গাজীপুরে ৩০ বনকর্মী । এদের মধ্যে গুরুতর চারজন এখনও চিকিৎসাধীন।

বন বিভাগের তথ্য মতে, বিএনপির নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বন দখলে উসকানি দিচ্ছে বেশ কয়েকজন কথিত নেতা। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন এলাকার কিছু নামধারী জনপ্রতিনিধি, দালাল এবং সুবিধাবাদীদের সমন্বয়ে বেশ কয়েকটি চক্র গাজীপুর বনাঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বন দখল প্রতিরোধ করতে গিয়ে হামলার শিকার হচ্ছেন বনকর্মীরা।গত ১২ সেপ্টেম্বর শ্রীপুর উপজেলার তেলীহাটি মৌজায় দখল প্রতিরোধ করতে গেলে বিএনপির নাম ব্যবহার করে বনকর্মীদের হত্যা করে লাশ গুম করার হুমকি দেওয়া হয়। ওই ঘটনায় সাতখামাইর বিট কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী গত ১৪ সেপ্টেম্বর শ্রীপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।

অনুসন্ধান বলছে, শ্রীপুর পৌর বিএনপির সাবেক এক সভাপতি আবুল মনসুর মণ্ডলের নাম ব্যবহার করে একটি চক্র পটকা মৌজায় বনের গাছপালা কেটে ক্লাবঘর নির্মাণ কাজ শুরু করে গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে। খবর পেয়ে বাধা দিতে গেলে বনকর্মীদের ধাওয়া করে চক্রটি। প্রাণ বাঁচাতে বনকর্মীরা শ্রীপুর রেঞ্জ অফিসে ফিরে আসে। এখনও ক্লাব ঘরটি টিকে রয়েছে। একইভাবে শ্রীপুর রেঞ্জের কাওরাইদ বন বিটের যুগিরসিট, সিপির মোড়, নয়াপাড়া, এলাকায় বিএনপির নাম ব্যবহার করে একটি সিন্ডিকেট ভূমিদস্যুদের বিভিন্ন এলাকায় বনে ঘরবাড়ি নির্মাণে সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া সাতখামাইর, রাথুরা বিটে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে একটি সিন্ডিকেট ভূমিদস্যুদের বনে ঘরবাড়ি নির্মাণে সহযোগিতা করে আসছে।

এ বিষয়ে বিএনপি নেতা আবুল মনসুর মন্ডল বলেন, ‘তিনি বা তার দল সরকারি বনভূমি দখল করার সঙ্গে জড়িত নয়, এটা চক্রান্ত হতে পারে। তবে তার নাম ব্যবহার করে যদি কেউ ক্লাবঘর নির্মাণ করেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ক্লাবঘরটি ভেঙে দিতে হবে। বন বিভাগ বলছে, গাজীপুর সদর উপজেলায় বনভূূমি দখল উৎসবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবিদ হোসেন বাবুল। তিনি বিগত দিনে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থাকলেও বর্তমানে ভূমিহীনদের সমর্থন পেতে ভূমিদস্যুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বন দখলে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করছেন। আবিদ হোসেন বাবুলের নেতৃত্বে গাজীপুর সদর উপজেলার মাইজপাড়া, ভবানীপুর, মোহাম্মদীয়া, নয়াপাড়া, গুচ্ছগ্রাম এলাকায় বনকর্মীদের পাশাপাশি সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ভূমিদস্যুরা। গত ৫ আগস্ট থেকে ভূমিদস্যুদের নিয়ে কয়েকটি জনসভা আয়োজন করেন আবিদ হোসেন বাবুল। এসব সভায় জবরদখল প্রতিরোধে গেলে বনকর্মীদের প্রতিরোধের ঘোষণা দেওয়া হয়। গত প্রায় দেড় মাসে ভবানীপুর বিটের বনকর্মীদের ওপর পাঁচটি হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় বনে ঘরবাড়ি, দোকানপাটসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মিত হয়েছে প্রায় এক হাজার। ভবানীপুর বিটে বন দখলের সূত্র ধরে পার্শ্ববর্তী মনিপুর বিটের বনকর্মীদের ওপর তিনটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ওই বিটের বনাঞ্চলে ঘরবাড়ি নির্মিত হয়েছে দুই শতাধিক। হামলার ঘটনায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে জয়দেবপুর থানায় তিনটি লিখিত অভিযোগ পাশাপাশি বনভূমি জবর দখলকারীদের তালিকা দেওয়া হয়েছে।এ বিষয়ে আবিদ হোসেন বাবুল বলেন, গত কয়েক দশক ধরে বন বিভাগের লোকজন স্থানীয়দের মিথ্যা মামলাসহ নানাভাবে হয়রানি করে আসছে। এ বিষয়ে স্থানীয়রা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করছেন।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট গাজীপুরের কালিয়াকৈর ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসে দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে আটটি চায়না রাইফেল, চারটি শর্টগানসহ ৭৫৫ রাউন্ড গুলি লুট করে। আগ্নেয়াস্ত্র লুট হওয়ার প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও অস্ত্রগুলো এখনও উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে আতঙ্কে রয়েছেন বনকর্মীরা। গত প্রায় দেড় মাসে কালিয়াকৈর রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুল করিম, চন্দ্রা বিট কর্মকর্তা আবদুল মান্নানসহ ১৫ বনকর্মীর ওপর পাঁচটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার ঘটনায় কালিয়াকৈর থানায় একটি মামলা ও একটি জিডি করেছে বন বিভাগ, তবু দখল অব্যাহত রয়েছে চন্দ্রা বিট সংলগ্ন ও কালামপুর মৌজার পুরো অংশে, কাশিমপুর বিটি এর অধীন লস্কর চলা, মৌচাক বিটের অধীন বরাব মৌজা , মধ্যপাড়া ও সাকাশ্বর মৌজা। একই উপজেলার কাচিঘাটা রেঞ্জে বন দখল প্রতিরোধ করতে গেলে গত ৫ সেপ্টেম্বর যাথিলা বিট কর্মকর্তা মাসুম মিয়া ও তার সঙ্গীয় বনকর্মীদের ওপর হামলা চালায় ভূমিদস্যুরা। এ ঘটনায় মাসুম মিয়া মাথায় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে চিকিৎসাধীন। বনকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় গত প্রায় দেড় মাসে কাচিঘাটা রেঞ্জের বিভিন্ন বিট থেকে কালিয়াকৈর থানায় একটি মামলা, একটি লিখিত অভিযোগ এবং পাঁচটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মোকলেছুর রহমান জানান, জবরদখল প্রতিরোধ তো দূরের কথা টহল কার্যক্রমেই বনকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। মাসের পর মাস বন বিভাগের দায়ের করা লিখিত অভিযোগের সুরাহা হয় না। বেশ কিছু এলাকায় বনকর্মীরা যাতে প্রবেশ করতে না পারেন, সেজন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ভূমি ও বনদস্যুরা। এভাবে চলতে থাকলে যে কোনো সময় বনকর্মীদের ওপর বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটতে পারে।কালিয়াকৈর রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুল করিম বলেন, জীবন হারানোর আতঙ্ক নিয়ে প্রতিটি বিটের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্ব পালন করছেন। স্বাভাবিক টহল কার্যক্রমে হামলার ঘটনা ঘটছে। চোখের সামনে বন দখল হয়ে যাচ্ছে। অথচ বন বিভাগ জেলা প্রশাসন থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছে না। বনভূমি রক্ষায় দ্রুত সাঁড়াশি অভিযান শুরু না হলে বেহাত বনভূমি রক্ষা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলেও তিনি জানান। রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিট কর্মকর্তা কে বিএম ফেরদৌস জানান, বিটের ইজ্জতপুর বাজারের আশপাশ এলাকা ও হালুকাইদে জবর দখল বেশি হচ্ছে।

এখানে প্রায় অর্ধশত দখলদার রয়েছে রাজেন্দ্রপুররে রেঞ্জ কর্মকর্তা জুয়েল রানা জানান, আমরা বনখেকোদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছি। রেঞ্জের রাজেন্দ্রপুর পূর্ব ও মনিপুর বিটে জবর দখল হচ্ছে। মনিপুর বিটের অবস্থা খুবই নাজুক। আমরা সেখানে যেতে পারছি না। ভাওয়াল রেঞ্জ কর্মকর্তা কাজী নাজমুল হক বলেন, মাত্র কয়েকজন ব্যক্তি মিলে একটি সিন্ডিকেট ভাওয়াল রেঞ্জের ভবানীপুর বিটের বনাঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, শুধু বন আইন প্রয়োগ করে এই ভূমিদস্যুতা বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই অরাজক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব না বলেও জানান তিনি। প্রশাসনের সহযোগিতা না পাওয়ার কথা অস্বীকার করে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফিন বলেন, বন বিভাগের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত সভা হচ্ছে। তাদের সহযোগিতা করতেও প্রশাসন সচেষ্ট। তবে এখন আমরা ভিন্ন একটি প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব পালন করছি, সে দিকটিও বিবেচনায় নিতে হবে। সব মিলিয়ে দেশ এখন আলো আঁধারের খেলা নিমজ্জিত। আশা ভরসার স্থল গুলো দিন দিন পিকে হয়ে যাচ্ছে।

খবরটি শেয়ার করুন